উলিপুরে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রাম বাংলার হুক্কা

আব্দুল মালেক উলিপুর:
কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্ৰামবাংলার ‘হুক্কাথ। মানুষের ধূমপানের অন্যতম মাধ্যম ছিল এটি। ধূমপানের জনপ্রিয় এই মাধ্যম গ্রামবাংলার বিনোদন, আতিথেয়তা, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতির প্রতীক। সে সময় ধনী-গরিব প্রতিটি বাড়িতেই ছিল হুক্কার প্রচলন। আজ থেকে দুই যুগ আগেও গ্রামগঞ্জে ধূমপায়ীরা হুক্কার মাধ্যমে নেশায় অভ্যস্ত ছিল। পুরুষের পাশাপাশি বয়স্ক নারী ও ছেলেমেয়েরাও হুক্কার মাধ্যমে ধূমপান করত। অনেকে শখের বশেও হুক্কায় আয়েশি টান দিত।
বিশেষ করে কৃষকদের দেখা যেত জমি চাষের সময়, চারা রোপনের সময় একটু বিশ্রম নেওয়ার সময় গাছ তলায় বসে মনের আনন্দে গান গাইতো আর হুক্কা টানতো। বর্ষাকালে যখন মানুষ ঘরের বাহিরে যেতে না পারতো তখন ঘরের বারান্দায় বসে এমন কি শীতকালে যখন খুব শীত পড়তো তখন গায়ের চাদর, লেপ-খাতা গায়ে দিয়ে হুক্কা টানতে দেখা যেত। এমনকি গ্রামের মোড়ল, মাতুববর যখন বিচার শালিশীতে বসত তখন হুক্কার পাইপ টানতো আর সকলের কথা বার্তা শুনে বিচারের রায় ঘোষণা করতো।
তামাক হুক্কায় ভরে টানাটাই ছিলো তখনকার সমাজে সমাজপতিসহ প্রজাদের মধ্যে বিশাল প্রচালন। হুক্কা খেতে গ্রাম বাংলার সেই পুরনো প্রথা আজ আর দেখা যায় না। গ্রামে গ্রামে বুড়োদের হুক্কা খাওয়া নেশা করার একমাত্র প্রথা এখন বিলুপ্তির পথে। প্রতিটি বাড়ি বাড়ি হুক্কা খাওয়ার সরঞ্জাম যেন বাড়ির একটি শোভা ছিল। যার বাড়িতে যত বেশি ঐসব সরঞ্জাম থাকতো, এলাকা জুড়ে তার পরিচিতি থাকতো তত বেশি। এতে করে শোভা পেত তার বাড়ির বৈঠকখানা বা কাচারী ঘর। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই বৈঠক খানা আর কাচারী ঘরও নেই, হুক্কার সরঞ্জাম নেই।
এছাড়া নাটক, সিনেমায় অভিনয়ে ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে পিতলের তৈরি ‘হুক্কাথ ও গরিবদের জন্য নারিকেলের খোল দ্বারা তৈরি ‘ডাবাথ ব্যবহার করা হতো। যা মানুষের জীবনের উঁচু-নিচু পার্থক্য নির্ণয় করত।
এক সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হুক্কা প্রতীক হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিল। সবকিছুই এখন বিলুপ্তি হতে চলেছে।
উলিপুর পৌরসভার নারিকেল বাড়ি স›ন্যাসীতলা এলাকার কয়েকজন বুড়োর সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামের বিভিন্ন বৈঠকখানায় মেহমানদের জন্য প্রধান আকর্ষণ ছিল হুক্কা। যে কোন বয়সের ছেলে ও বয়স্করা হুক্কার নেশায় মাতোয়ারা ছিল। তামাক পাতাগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে এতে চিটাগুড় মিশ্রিত করে তৈরি হত হুক্কার প্রধান উপাদান ‘তামুকথ। মাটির তৈরি কলকিথর মধ্যে তামুক কয়লার টুকরার মাধ্যমে আগুন দিয়ে ধূমপান করা হতো। এটা একপ্রকার নেশার মতো। হুক্কায় ধূমপানের জন্য এক সময় হাটবাজারে তামাকের গুড়ি মিশ্রিত করে বিক্রি করতে দেখা যেত, বিক্রি করা হতো নারিকেলের খোল দ্বারা হাতে তৈরি হুক্কা। যা ‘ডাবাথ নামে পরিচিত ছিল। হুক্কা নিয়ে গ্রামবাংলায় একটি জনপ্রিয় লোকগান প্রচলিত ছিল। পরাণের হুক্কারে তোর নাম কে রাখিলো ডাবা, হুক্কা আমার নাতিপুতি হুক্কা আমার বাবা —-। তবে হুক্কা খাওয়া প্রথা বিলুপ্ত হতে চললেও এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন পৌরসভার নারিকেল বাড়ি স›ন্যাসীতলা গ্রামের যুবক ও বয়স্করা। এখানে মাঝে মধ্যে এখনও হুক্কা খাওয়ার আসর বসে। হুক্কা টানতে বসা যুবক টুকু চন্দ্র বর্মন বলেন, বাপ দাদার হুক্কা খাওয়া দেখেছি। তাই বাপ দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য হুক্কা খাচ্ছি। এখন ঠান্ডার দিন হুক্কা টেনে গা গরম করছি। একই ধরনের কথা বললেন বাবলু চন্দ্র বর্মন, ট্রিপিল চন্দ্র বর্মন সহ আরো অনেকে।
তবে কালের পরিক্রমায় উপজেলার গ্রামে গ্রামে হুক্কায় তামাকপানের যে প্রচলন ছিল তেমন আর দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হুক্কায় ধূমপান করা দূরে থাক চোখেই দেখেনি। হুক্কার জায়গা দখল করে নিয়েছে বিড়ি, সিগারেট, ইয়াবা, গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। যার মধ্যে রয়েছে মারাত্মক ক্ষতিকর নিকোটিন। তার পরেও এই মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়েছে যুব সমাজ। যাদের নিয়ে দেশের সব অভিভাবক মহল থাকেন সব সময় উদ্বিগ্ন। এক কালের গ্রাম বাংলার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান ‘হুক্কাথ আজ বিলুপ্তির পথে।