শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:১৭ অপরাহ্ন

পাগলী মায়ের ছেলে

রিপোর্টারের নাম / ১১০ টাইম ভিউ
Update : মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

—–ফারুক আহম্মেদ জীবন

 

রাত প্রায় বারোটা বাজে। বাইরে মুষলধারে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সাথে ঝড়ও বইছে সমান তালে। মাঝেমধ্যে মেঘ গর্জন করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রেণুর একমাত্র মেয়ে ঝুমু-কে নেওয়া হয়েছে ঢাকা
রামপুরার এক বেসরকারী প্রাইভেট ক্লিনিকের ও টি রুমে। ক্লিনিকের বারান্দায় উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারী করছে ঝুমুর বাবা রনজু মিয়া । আর ঝুমুর মা রেণু বেগম দুঃশ্চিন্তা মুখে বারান্দার এক কোণে চেয়ারে বসে বারবার ও, টি রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ শিশুর কান্নার আওয়াজ। রেণু বেগম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। রনজু মিয়ারও হাঁটা থেমে গেলো।একটু পরেই রুমের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো গাইনী ডাক্তার নিলু।
রনজু মিয়া আর তার স্ত্রী রেণু ছুটে গেলো ডাক্তার
নিলুর কাছে। ঝুমুর কথা জিজ্ঞাসা করতে।ডাক্তার নিলু হেসে উঠে বললো আপনাদের নাতি হয়েছে। এখন মা- ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে। কিন্তু ঝুমুর
বাবা-মার মুখে হাসির লেশমাত্র নেই।
কি করে থাকবে? আজ যেখানে তাদের খুশি হওয়ার কথা। সেখানে লজ্জায় তাদের মাথা নুইয়ে
আসছে। তাদের মেয়ে ঝুমুর যে এখনো বিয়েই হয়নি। লোক সমাজে মানুষের কাছে বাচ্চাটির তারা কি পিতৃ পরিচয় দেবে?
কি করে মানুষদের বলবে? এক কাপুরষ তাদের মেয়ের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে এমন সর্বনাশ করে পালিয়েছে। সেই লম্পটের লোভের
ফসল এই শিশুটি। মেয়ে ঝুমু এখনো অচেতন।
এই সুযোগ বাচ্চাটাকে সরিয়ে তাদের মান সম্মান
রক্ষা করার। রনজু মিয়া একজন ব্যবসায়ী।যথেষ্ট
টাকার মালিক। রনজু ডাক্তারকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে মোটা অংকের টাকা দিল যেনো তারা মুখটা বন্ধ রাখে। আরো বললো আমার মেয়ে জ্ঞান ফিরার পর জিজ্ঞাসা করলে বলবেন তার মৃত বাচ্চা হয়েছে। ঝুমুর মা রেণু বেগমের সম্মতি না
থাকলেও স্বামীর উপরে সে কোন কথাও বলতে
পারছে না। ঝুমুর বাবা দ্রুত রুমে ঢুকে বাচ্চাটাকে
কাপড়ের টোপলায় জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব দ্রুত পায় গাড়িতে গিয়ে গাড়ি স্ট্রাট করলো ।মেয়ে ঝুমুকে একনজর দেখে সাথে ঝুমুর মা- রেণু বেগমও গেলো রনজুর সাথে।
তারপর গাড়ি করে কিছুদূর নির্জন একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে রাস্তার পাশে বাচ্চাটাকে ফেলে তারা চলে এলো।জ্ঞান ফিরার পর বাচ্চাকে দেখতে না পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করলো ঝুমু। তার মৃত বাচ্চা হয়েছে, এটা সে মানতে নারাজ। ঝুমু কাঁদছে আর বলছে।না আমি বিশ্বাস করিনে।আমার সন্তানের কান্না আমি নিজের কানে শুনেছি। তোমরা মিথ্যে বলছো। অনেক বুঝানো হলো ঝুমুকে। এই বলে, সে ভুল শুনেছে।

এর কয়েক মাস পর ঝুমুর প্রেমিক রাতুল ফিরে এলো। ঝুমুদের বাড়িতে এলে ঝুমুর মা-বাবা তাকে অনেক অপমান অপদস্ত আর কটু কথার টর্চার করলো। রাতুল সবি বুঝিয়ে বললো তার মায়ের হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়ায়, সে দ্রুত পাঁচফুট ভিসা করে তার মাকে নিয়ে সিংগাপুর গিয়েছিল। ঝুমুর সাথে দেখা করার বা যোগাযোগ করার মত অবস্থা তখন তার ছিল না। তবু মাকে বাঁচাতে পারিনি। তিন মাস পর গতপরশু সে তার মায়ের লাশ নিয়ে বাড়িতে এসেছে। গতকাল মায়ের দাফন করা হয়েছে। আর আজ এখানে এসেছে ঝুমুর সাথে দেখা করতে।সে সত্যি ঝুমুকে ঠকাতে চাইনি। তার ভালোবাসা কোনো মিথ্যা না। ঝুমুকে সে রীতি-
মতো রেজিষ্ট্রেশন করে শরীয়ত মতে বিয়ে করেছে। ঝুমু রাতুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো সেই তো এলে।তবে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হওয়ার পর এলে রাতুল। ওদের বিয়ের কথা শুনে ঝুমুর মা-বাবা, রনজু আর রেণু দুজন দু,দুজনার দিকে তাকাতাকি করতে লাগলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো। তোমাদের বিয়ে হয়েছে একথা আমাদের আগে জানাওনি কেনো? রনজু বললো আমাদের বিয়েটা গোপন রেখে ছিলাম।ভেবেছিলাম আমার ব্যারিস্টারী পড়া আর ঝুমুর মেডিকেল পড়া শেষ হলে দুই পরিবারের সবাইকে জানাবো। ঝুমুকে আমার ঘরের বউ করে তুলে নিয়ে যাবো। কিন্তু.এরইমাঝে….

ওরা বিয়ে করেছে! তার মানে বাচ্চাটা অবৈধ নয়।
রনজু মনে মনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো এ আমি কি করেছি? আমি বাপ হয়ে আমার মেয়ের.
না, আর ভাবতে পারছেনা রনজু।
“তারা যে অপরাধ করেছে তা- না পারছে তাদের সাথে বলতে আর না পারছে সইতে। অপরাধ আর অনুশোচনায় ভুগতে লাগলো ঝুমুর
বাবা-মা দুজনেই। নিষ্পাপ শিশু হত্যার কারণে অপরাধবোধ যেনো ঝুমুর মা-বাবাকে পিছু তাড়া করে ফিরতে লাগলো”। এর কয়েকদিন পর আবার দুই পরিবার মিলে ধুমধাম করে বিয়ে দিল
ঝুমুর সাথে রাতুলের। রাতুল ব্যারিস্টারী শেষ করে হাইকোর্টে প্রাকটিস করছে। আর ঝুমু এখন ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার।

এই ঘটনার বছর দশেক পরে….

ছোটকু নামের দশ বছরের একটা ছেলে। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় সে তার মাকে রক্তাক্ত দেহে রেখে এসে। মায়ের চিকিৎসার টাকার জন্য উদাসীন ভাবে আনমনা হয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ব্যস্ত শহর ঢাকা কাওরান বাজারের এফডিসির সম্মুখের রোড ধরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। তেল হীন, ধুলো উড়া, কুঁকড়ানো, উসকোখুসকো মাথা ভর্তি চুল। সে চুলে কতোদিন যে, চিরুনির ছোঁয়া লাগেনি তার কোনো ঠিক নেই।
পরনে ছেঁড়া ছুটো ময়লা নেভি ব্লু রঙের একটা হাফপ্যান্ট। আর গায়ে কমলা রঙের একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। কয়েক বেলা ক্ষুদার্ত থাকার কারণে মুখটা-
ও একেবারে শুকিয়ে গেছে।
ছোটকু হাঁটছে..আশপাশে কোনদিকে তার খেয়াল নেই। মনটা একদম ভালো নেই ছোটকুর আজ।
কি করে ভালো থাকবে?
যে পাগলী মাকে অবলম্বন করে তার এই সুন্দর পৃথিবীতে দৈনন্দিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা। সেই
মা-যে, রোড এক্সিডেন্ট করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। যদিও পাগলীটা তার আপন গর্ভধারিণী মা- না।

“তবুও, সেই পাগলী মা-টাই তো, নিজে খেয়ে না খেয়ে, তার মুখের ভাত ছটকুর মুখে তুলে দেছে।
ফুটপাতে রৌদ্র, বৃষ্টি, ঝড়, তুফানে তারই মায়ার আঁচল তলে বুক দিয়ে আগলে রেখে সমস্ত ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে ছটকুকে বাঁচিয়ে রেখেছে।এতোটুকুও কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি ছটকুকে”।

ছোটকুর একটু বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর সে একদিন
তার পাগলী মায়ের মুখে শুনেছিল।সেদিনের কথা আজো ছটকুর স্পষ্ট মনে আছে। ছটকু জিজ্ঞাসা করেছিল? আচ্ছা মা, লোকজন বলাবলি করে
তুমি নাকি আমার গর্ভধারিণী আপন মা না?
এ কথা কি সত্যি? তুমি নাকি আমাকে পথের ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলে?
“ছটকুর মুখে ঐ কথা শুনে পাগলী মা,মমতার চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠেছিল। মাতৃ স্নেহে ছুটকুকে বুকে টেনে নেয় সে।
আবারো ছটকু জিজ্ঞাসা করলো বলো না মা, তুমি কি আমায় কুড়িয়ে পেয়েছিলে?
“পাগলী কাঁদতে কাঁদতে ছটকুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে হ- রে বাজান হ.। মানষে তোকে ঠিকই বলে বাজান।আমি তোর গর্ভধারিণী আপন
মা-না। আমি তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম-রে বাজান.কুড়িয়ে পেয়েছিলাম”।
তারপর চোখের জল মুছে কল্পনা করে সেদিনের সে ঘটনা বলতে থাকে ছটকুকে….
বলে, শোন তাহলে বাজান…এক ঝড়বৃষ্টির গভীর রাতে আমি রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনের পথ ধরে ভিজতে ভিজতে আসছিলাম..কিছুদূর আসার পর হঠাৎ!
পথের ধারের ময়লা আবর্জনার স্তুপের মধ্য থেকে একটা ছোট্ট শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়! ভাবি, আশেপাশে তো কোথাও কোনো লোকজন নেই। তাহলে এখানে শিশুর কান্নার শব্দ কেনো? ময়লা আবর্জনা সব তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি আমি। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সেই ময়লা আবর্জনার স্তুপের একটা কাপড়-চোপড়ের
পুটলার মধ্যে তোকে পাই।আমি যেই তোকে বুকে তুলে নিই। আর অমনি তোর কান্না থেমে যায়। কি সুন্দর মায়াবী দুটি চোখে তুই পিটির-পিটির করে তাকাচ্ছিলি আমার মুখের দিকে। মনে মনে বলতে থাকি আহারে! এমন সুন্দর নিষ্পাপ ফুটফুটে দুধের শিশুটিকে এভাবে নিষ্ঠুর পাষাণের মতো কে ফেলে রেখে গেছে? তার কি এই নিষ্পাপ অবুঝ মুখটা দেখেও একটু মায়া লাগেনি?
“আমি যে পাগলী মানুষ। ঘরবাড়ি বলতে আমার কোনো কিছু নেই।ফুটপথে পড়ে থাকি। ভিক্ষা করে খায়। কোথায় রাখবো তোকে? কি-বা তোকে খেতে দেবো? এসব নানান সাতপাঁচ ভাবতে থাকি। অবশেষে ভাবলাম এই রাতে এভাবে যদি তোকে রেখে যায়। তাহলে শিয়াল কুকুর তোকে ছিঁড়ে
ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। তারচেয়ে আমার সাথে নিয়ে
যায়। যে মা-বাপ তোকে জন্ম দিলো। তাদের কাছে যখন তোর ঠাঁই হলো না। আমিই তোকে ঠাঁই দেবো। মায়ের আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলবো। তুই এই পাগলী মায়ের ছেলের পরিচয় নিয়েই বড় হবি। তারপর আমি মানষের কাছে হাত পেতে চায়ের দোকান থেকে দুধ কিনে তোকে খাওয়াতে
থাকি। তারপর তুই একটু খাওয়ার মতো হলে।কলা রুটি কিনতাম দুধের সাথে ভিজিয়ে তোকে খাওয়ানোর জন্য। সব শুনে ছটকুর দু,চোখ জলে ভরে গেলো। বললো, মা, লোকে তোমাকে পাগলী বললেও, তুমিই আমার মা।
আমি তোমার মতো পাগলী মায়ের ছেলে পরিচয় নিয়েই এই সমাজে বড় হতে চাই মা। পাগলী ছটকুর মুখে এমন কথা শুনে ছটকুর চোখের জল মুছে সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।আর বলতে লাগলো, হরে বাজান তুই আমারই ছেলে বাজান। আর অন্য কারোর না। শুধু, আমিই তোর মা-রে বাজান, আমিই তোর মা।
সেদিনের সেসব কথা ভাবতে ভাবতে ছটকুর দুটি
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কি করে বাঁচাবে এখন
তার সেই মাকে? ছটকুর গানের গলা বেশ ভালো।
সে ভাবলো ভিক্ষা চাইলে মানুষ বেশি টাকা দেবে না। তারচেয়ে সে তার পাগলী মায়ের জন্য গান
গেয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইবে।
তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের দয়া হবে।
সে কচি মায়াবী গলায় মধুর কন্ঠে গান গাইতে লাগলো। আর দোকান্দার থেকে শুরু করে পথের সকল মানুষজনদের কছে দু,হাত পেতে সাহায্য চাইতে লাগলো।
ছটকু যখন গান গাওয়া শুরু করলো। ঐ পথ দিয়ে দামী প্রাইভেটে যাচ্ছে ঝুমুর মা-বাবা, রনজু
আর রেণু বেগম। ছটকুর গান শুনে আর তাদের
মেয়ে ঝুমুর চেহারার সাথে ওর হুবহু মিল দেখে
মনে খটকা লাগলো। গাড়ি রাস্তার একপাশে রেখে
ওরা ছটকুর পিছু পিছু যেতে লাগলো।
সে গানটা হলো……
তোমাদের মাঝে কেউ কি এমন
নেই, কোনো দয়াবান?
যে একটু, করবে মেহেরবান…..
মৃত্যু এক, পথও যাত্রী মায়ের জন্য
করবে, কয়টা টাকা দান?
তবে যে, টাকা পেলে বাঁচবে আমার
পাগলী মায়ের প্রাণ।।

একদিন, যে-মা, আমার কান্না দেখে
রাস্তার, আবর্জনার মধ্য থেকে….
তুলে, বুকে দিলো ঠাঁই,
আমার, সেই মায়ের বাঁচাতে জীবন
আজ, তোমাদেরই কাছে আমি
দুটি, সাহায্যেরও হাতটি বাড়ায়
চাই, একটু অনুদান।।

একদিন,যে- মা আমার কুড়িয়ে পেয়ে
নিজের, বুকে তুলে নিলো…
যে- মা, নিজে খাবার না খেয়ে সে
আমার, মুখে তুলে দিলো।।
আজ আমার, সেই মা মৃত্যু যন্ত্রণাতে
কাতরায়, হাসপাতালের বারান্দায়….
আমার, সেই মাকে বাঁচাতে যে
গাই আমি এ গান।।

ছটকুর কান্না জড়িত করুণ কন্ঠে অমন মায়া জড়ানো গান শুনে যে যার সাধ্যমত টাকা দিতে
লাগলো। গান শেষে ছটকু কাঁদতে কাঁদতে সবার দেওয়া টাকা গুলো কুড়িয়ে একজায়গায় করতে
লাগলো। ছটকুর কাছে ছুটে গেলো রনজু রেণু।
বললো, তোমার নাম কি? ছটকু চোখের জল মুছে বললো ছটকু। রনজু বললো, তুমি যে গান
গাচ্ছিলে তোমায় কুড়িয়ে পেয়েছে। কোথায়, কে
কুড়িয়ে পেয়েছিলো তোমাকে? আমাদের জানা দরকার সবকিছু আমাদের বলো? ছটকু বললো,
আমি এরচেয়ে বেশি জানিনে। আমার পাগলী মা
জানে। আপনারা কে? রেণু বললো, আমরা কে ভাই সবি জানবে। ছটকু বললো সরুন আমাকে এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে। আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে। রনজু বললো, কোন হাসপাতালে ভাই ছটকু? ছটকু বললো ঢাকা মেডিকেলে। রনজু বললো, চলো আমরাও তোমার সাথে যাবো। তুমি গাড়িতে ওঠো। ছটকু গাড়িতে উঠতেই রনজু গাড়ি চালিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেলে গেলো। ছটকুর পাগলী মা, মমতার অবস্থা খুবি সংকটপূর্ণ। ঝুমুই চিকিৎসা দিচ্ছে। পাগলী মমতা ক্ষত দেহে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর এদিকওদিক তাকিয়ে চারদিকে শুধু ছটূকুকে খুঁজছে। বারবার বলছে ছটকু…আমার ছেলে ছটকু কই? ছটকু
গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে হাসপাতালের ভিতর তার পাগলী মায়ের কাছে গেলো। গিয়ে মমতাকে জড়িয়ে ধরে বললো এইতো আমি মা। তোমার কিচ্ছু হবে না। এই দ্যাখো তোমার চিকিৎসা আর ওষুধ কেনার জন্য আমি অনেক টাকা এনেছি। তুমি ভালো হয়ে যাবে মা, তুমি ভালো হয়ে যাবে।
পাগলী মমতা বললো, আমি আর বাঁচুম নারে বাবা ছটকু।রাতুল কিছুক্ষণ আগে ঝুমুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেও হাসপাতালে আছে। ছটকুর পিছনে ঝুমু ওর মা-বাবাকে দেখে বললো, কি ব্যাপার আম্মু, আব্বু তোমরা এখানে? ঝুমুর বাবা রনজু বললো সব পরে বলছি মা। মমতাকে দেখিয়ে বললো আগে উনাকে ভালো চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ কর মা ঝুমু। পাগলী মমতা খুব কষ্টে ছটকুকে বললো উ…না…রা…কে-রে বাবা ছটকু? ছটকু বললো উনারা তোমার কাছে কি যেনো জানতে চাই মা। মমতা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
রনজু পাগলী মমতাকে উদ্দেশ্য করে বললো হ্যা, বলুন, দশ বছর আগে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে ছটকু কে আপনি কোথায় পেয়েছিলেন? মমতার মৃত্যু শ্বাস ওঠে গেছে। খুব কষ্টে কল্পনায় সব বললো। সেদিন শুক্রবারের রাত ছিল।একটা কালো চকরা
-ফকরা রঙের কাপড়ে জড়ানো ছিল ছটকুকে।
অনেক কষ্টে পাগলী মমতা তার টোপলা থেকে সে
কাপড়টা বের করে বললো এই কাপড়টিতে। রনজু ছোঁ মেরে সে কাপড়টা নিলো। চিনতে কষ্ট হলো না। সে এই কাপড়ে জড়িয়েই সে রাতে ঝুমুর শিশু পুত্রটিকে ফেলে রেখে এসেছিলো। রেণু, রনজু, একইসাথে বলে উঠলো হ্যাঁ, এইতো সেই কাপড়। তার মানে এই ছটকুই আমাদের নাতি, ঝুমুর ছেলে। রাতুল ঝুমু বললো,ছটকু…ছটকু আমাদের ছেলে? কিন্তু
সেদিন যে বলেছিলে…? রনজু বললো, ভুল করেছিলাম মা। ভেবেছিলাম তোদের বিয়ে হয়নি.. তাই লোক লজ্জার ভয়ে…। আমাদের তুই ক্ষমা করে দে, মা। রাতুল তুমিও আমাদের ক্ষমা করো বাবা। ঝুমু,কাঁদতে কাঁদতে ছটকুকে বুকে টেনে গায় মাথায় হাত বুলিয়ে সারা মুখে চুমু খেতে খেতে বলতে লাগলো ছটকু.. তুই আমার ছেলে বাবা। এতোদিন তুই কোথায় ছিলি সোনা। আমার বুকের ধন দু, নয়নের মণি। রাতুলও উবু হয়ে ছটকুকে বুকে টেনে চুমু দিতে লাগলো। ছটকু পাগলী মমতাকে ধরে বললো না, আমি শুধু আমার পাগলী মায়ের ছেলে। পাগলী মমতা কথা বলতে পারছে না। খুব কষ্টে বললো, আমার আর সময় নেইরে বাবা। তুই আমার ছেলে এটা ঠিক। কিন্তু ওরাই যে তোর সত্যিকারের জন্মদাতা আর গর্ভধারিণী মা-বাবা। তারপর ছটকুর কপালে একটা চুমু দিতেই মমতা চিরতরে নিস্তেজ হয়ে গেলো। হাত দুটি ছটকুর মাথা থেকে নিচে পড়ে গেলো। ঝুমু তার হাত দিয়ে মমতার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বললো, উনি মারা গেছেন বাবা ছটকু। ঐ কথা শুনে ছটকু চিৎকার করে কেঁদে ওঠে তার পাগলী মা মমতা-কে ধরে বলতে লাগলো। না…আমার মা আমাকে ছেড়ে মরতে পারে না। ও মা….মা…কথা বলো মা… তুমি কথা বলো। এভাবে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না মা, কথা বলো মা… কথা বলো। শুধু একবার তুমি আমাকে ছটকু বলে ডাকো মা..শুধু একবার…।তারপর বললো, এখন আমি কার কাছে থাকবো মা, কার কাছে…।ঝুমু আর রাতুল দু,জন ছটকুকে বুকে টেনে বললো, তুই আমাদের কাছে থাকবি বাবা। তুই যে আমাদের ছেলে.। তবু ছটকু তার পালিত পাগলী মা মমতার দিকে তাকিয়ে মা…
আমার মা..বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো..।

নারাংগালী ঝিকরগাছা যশোর বাংলাদেশ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর