বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন
প্রহলাদ মন্ডল সৈকত:
জনবল সংকটের কারণে কুড়িগ্রামের রাজারহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশ ও সার্জারিসহ বিভিন্ন ধরনের জরুরি কার্যক্রম মুখ থুবরে পড়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে সাধারণ রোগীরা। হয়রানীর শিকার হয়ে রোগীদের অন্যত্র প্রেরণ করা হচ্ছে। এসব দাবী করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনো ওই হাসপাতালের রাঁধুনী, পরিচ্ছন্নকর্মী আর মালিরাই সার্জারি ও অপারেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের সাথে গোপনে কথা বলে জানা গেছে। তারা বলেন, হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা যাচাই করলেও বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এদিকে মঙ্গলবার (১৬মে) মহামান্য হাই কোর্টের একজন আইনজীবি আলহাজ্ব মোঃ আসাদুজ্জামান আনসারী বিষয়টি নিয়ে রিট করেন। বুধবার(১৭মে) আদালতের বিচারপতি জেবিএম হাসান ও রাজিক আল জলিলের দ্বৈত বেঞ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে জনবল সংকটের তালিকা চেয়ে আদেশ দিয়েছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১২সালে এই হাসপাতালটি ২৫শয্যা থেকে ৫০শয্যায় উন্নতি করা হয়। জনবল রয়েছে মেডিকেল অফিসার রয়েছে ১০জনের মধ্যে আছে ৮জন, নার্সিং সুপারভাইজার ১৫১ জন, সিনিয়র নার্স ২৬জন, মিড ওয়াইফ ৬জন,ল্যাব টেকনিশিয়ান ২জন, প্রধান সহকারি ১জন,অফিস সহায়ক ৩জন,ফার্মাসিস্ট ২জন,পরিসংখ্যান ১জন, স্বাস্থ্য পরিদর্শক ২জন,এ্যাম্বুলেন্স চালক ১জন, মালি ১জন, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ৭টি পদে মধ্যে ৫জন,পরিচ্ছন্নকর্মী ৫টি পদের মধ্যে ৩জন। স্বাস্থ্য সহকারি ৩০টি পদের মধ্যে ১৭জন,সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক ৬টি পদের মধ্যে ৪জন,ওয়ার্ড বয় ৩টি পদের মধ্যে আছে ১জন। এছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেন্টাল চিকিৎসক, এমটি ডেন্টাল,ইপিআই,রেডিও গ্রাফার,কার্ডিওগ্রাফার, ক্যাশিয়ার, স্টোরকিপার, জুনিয়র মেকানিকেল গুলো শূন্য রয়েছে।
প্রয়োজনীয় লোকজন না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্জারি করছেন ওই হাসপাতালের রাঁধুনী, পরিচ্ছন্নকর্মী আর মালি। এতে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন রোগীরা। এ রিপোর্ট বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার পর টক অফ দ্যা রাজারহাটে পরিনত হয়। সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জনবল সংকটকে দায়ী করেন ।
মঙ্গলবার(২৩মে) দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। পরিচ্ছন্ন কর্মী মিজানুর রহমান জরুরী বিভাগে অপারেশন করছেন। ক্যামেরা দেখে দ্রুত সরে আসেন তিনি। পাশে বসে ছিলেন গাইনী চিকিৎসক ডাঃ নাহিদ ও একজন সিনিয়র নার্স। তারাও ক্যামেরা দেখে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে অপারেশনে হাত লাগান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসক দাবী করছেন, কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কাউকে যেখানে সেখানে কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু এখন রবি, দেলোয়ার, মিজানুররা আর সহযোগী হিসেবে থাকেন না। ফলে রোগীদের ছোট খাট অপারেশন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে অপারেশনটা ডাক্তারদের একটা টিম ওয়ার্ক। একজন না থাকলে কাজ করা সম্ভব হয় না। আর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় লোকজন নাই। দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতে লোক নিয়োগ বন্ধ রযেছে। সহযোগী না পেলে অপারেশন করা যায় না।
গোপনে বেশ কিছু রোগীদের সাথে বলে কথা বলে জানা যায়, এখনো ওই হাসপাতালের রাঁধুনী, পরিচ্ছন্নকর্মী আর মালিরাই সার্জারি ও অপারেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকের সাথে সার্জারিতে অংশ নেন অবসর নেয়া পরিচ্ছন্নকর্মী রবি দাস। শুধু অপারেশন থিয়েটার নয়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও তিনি সার্জারির কাজ করে আসছেন নিয়মিত। তার মতো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগসহ অপারেশন থিয়েটারে সার্জারির কাজ করেন নিয়মিত রাঁধুনি, মালি এবং পরিচ্ছন্নকর্মী। আর এই কাজ করে রোগীদের নিকট হতে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে থাকলেও জনগনের সেবা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়নি কোন কার্যকরি পদক্ষেপ। ফলে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছে দেশের দারিদ্রপীড়িত এই অঞ্চলের মানুষ।
সাবেক পরিচ্ছন্নকর্মী রবি দাস বলেন, আমি গত ১ডিসেম্বরে ঝাড়–দার পোষ্ট থেকে অবসর নিয়েছি। আমি ওটি এবং জরুরি বিভাগে নিয়মিত কাজ করে আসছি। ডেসিং এবং সেলাইয়ের কাজ করতে পারি। সাবেক অনেক চিকিৎসকের সাথেও আমি কাজ করেছি। কিন্তু কাগজে নিউজ প্রকাশ হওয়ায় আমি আর এসব কাজ করছি না।
রাঁধুনি পদের বাচ্চু মিয়া বলেন, আমার পদ রাঁধুনি হলেও আমি জরুরি বিভাগের সব কাজই পারি। এর আগেও আমি কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী, ফুলবাড়িসহ অন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করেছি। এই হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় না থাকায় জরুরি বিভাগ দায়িত্ব পালন করছি। আমার মতো হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মালি পদের দেলোয়ার হোসেন, মিজানুরও কাজ করে থাকেন।
স্বেচ্ছাসেবক মালি পদের দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি ফুলের বাগান দেখভালের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। জরুরি বিভাগেও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা করেন। পাশাপাশি সেলাই ও ডেসিংয়ের কাজও করতে পারেন বলে জানান তিনি।
কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসক দাবী করছেন, কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কাউকে যেখানে সেখানে কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু এখন রবি, দেলোয়ার, মিজানুররা আর সহযোগী হিসেবে থাকেন না। ফলে রোগীদের ছোট খাট অপারেশন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে অপারেশনটা ডাক্তারদের একটা টিম ওয়ার্ক। একজন না থাকলে কাজ করা সম্ভব হয় না। আর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় লোকজন নাই। দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতে লোক নিয়োগ বন্ধ রযেছে। সহযোগী না পেলে অপারেশন করা যায় না।
গোপনে বেশ কিছু রোগীদের সাথে বলে কথা বলে জানা যায়, এখনো ওই হাসপাতালের রাঁধুনী, পরিচ্ছন্নকর্মী আর মালিরাই সার্জারি ও অপারেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু উপজেলার বৈদ্যের বাজারের বাসিন্দা শ্রী বাবলু চন্দ্র রায় বলেন, আমার মায়ের বয়স প্রায় ৭৫বছর হয়েছে। তার বাম পা একটু কেটে গিয়ে ইনফেকশন হয়ে পায়ে পচন ধরেছে। দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নেয়া হচ্ছে। রবি ভাই, দেলোয়ার ভাই আমার মায়ের পা ডেসিং করেন নিয়মিত। এজন্য আমি খুশি হয়ে তাদেরকে ডেসিং করার সময় কিছু বকশিস দেই যেন ভালো করে কাজ করেন।
বোতলার পাড় গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমার পুত্রবধুর ইনফ্লাম খোলার জন্য রাজারহাট হাসপাতালে এসেছি। সেখানে কাজ করা লোককে তো নাম জানি না। কালো করে খোঁচা খোচা দাড়ি থাকা এক ব্যক্তি ইনফ্লাম খুলে দিয়ে একশ টাকা নিয়েছে। আবার এক সপ্তাহ পড় ডেকেছে।
ছাটমল্লিকবেগ গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ডান পাশে কোমড়ের উপরে একটি টিউমার হয়েছে। এটা দেখানোর জন্য রবি ভাইয়ের কাছে এসেছি। তিনি কি পদে কাজ করেন সেটা তো বলতে পারিনা। এরআগেও তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি।
ভুক্তভোগী রোগী দেবিচরণ গ্রামের বাসিন্দা সুনিল চন্দ্র রায় বর্মন বলেন, পারিবারিক কোন্দলের জেরে আমার উপর হামলা হয়। এতে করে আমার ডান হাতের আঙ্গুল ও বাম হাতের একটি আঙ্গুলে কোপ লেগে কেটে যায়। পরে আমি হাসপাতাল গিয়ে দেখি দেলোয়ার ভাই অন্য রোগীদের ডেসিং করছেন। আমার ভাঙ্গা হাতে প্লাষ্টার করেন ডাঃ বাপ্পি স্যার এবং দেলোয়ার ভাই কাটা আঙ্গুলে সেলাই করেন। সেলাই করতে গিয়ে সুঁচের ঘুতা লাগে আঙ্গুলের হাড়ে এতে করে আমি কিছুটা ব্যথা অনুভব করি। কিছু দিন চিকিৎসা নেবার পর এখন আমি বাড়িতে চলে আসছি।
মেকুরটারি গ্রামের বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন,এই হাসপাতালে ঝাঁড়ুদার সেলাই করে আবার সেই ঝাড়ুদারে ঔষধ দেয়। ভর্তি রোগিদের দেখতে নিয়মিত ডাক্তাররা রাউন্ট দেয় না। একবার দেখলে পরের দিন আবার আসে ডাক্তার। সঠিক ভাবে রাজারহাট উপজেলার মানুষ চিকিৎসা,ঔষধ পায় না।
তিনি আরও বলেন, এই হাসপাতালে ৩জন ওয়ার্ডের বিপরীতে আছে একজন। সে বর্তমানে কর্মরত আছেন উমর মজিদ ইউনিয়ন সাব সেন্টারে।
বুধবার (২৪মে)রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি যেহেতু হাই কোর্টে মামলা হয়েছে। শুনাণীও হয়েছে। কিন্তু আমরা কোন কাগজ পাইনি। কুড়িগ্রাম জেলার সকল হাসপাতালের জনবলের তালিকা কুড়িগ্রাম সির্ভিল সার্জন সাহেব পাঠাবেন।