বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০১ অপরাহ্ন
সোহেল রানা:
কুড়িগ্রামে হতদরিদ্রদের জন্য চালু করা ১১০ দিনের ইজিপিপি প্লাস বা কর্মসৃজন কর্মসূচির নামে জনপ্রতিনিধিরা পকেট ভারী করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সুবিধাভোগীদের সিম কার্ড না দিয়ে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অজুহাতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে জেলা-উপজেলা প্রশাসন বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ দিয়েছেনও ভুক্তভোগীরা। এ প্রকল্পে কুড়িগ্রাম সদর,রাজারহাট এবং উলিপুর উপজেলায় ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। জনপ্রতিনিধিদের সচ্ছল আত্মীয়স্বজনের নামসহ ঘুষের বিনিময়ে সুবিধাভোগী নির্বাচন করা,সুবিধাভোগীর কাছে সিম কার্ড না দিয়ে জনপ্রতিনিধিরা তাদের কাছে রেখে ন্যায্য বিল না দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে জেলার সিংহভাগ ইউনিয়নগুলোতে। সরেজমিনে দেখা যায়,১৩ মে শনিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডে কর্মসৃজন কর্মসূচির শ্রমিকরা ধান কাটছেন। তবে দিনমুজরির বিনিময়ে নয়,কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের সভাপতি আব্দুল হক তার নিজের জমির ধান কেটে নেন প্রকল্পের শ্রমিক দিয়ে।
এ ছাড়া কিছু শ্রমিক দিয়ে তার বাড়িতে মাটি কাটার কাজ করান। এই ওয়ার্ডে চলমান কর্মসূচিতে মেম্বারের আত্মীয়স্বজন থাকলেও তারা কাজ করছেন না। অথচ তাদের নামে বিল তোলা হয়েছে। এই প্রকল্পের শ্রমিক ভোলা মিয়া বলেন,সরকার তো দিছে হামাক মাটি কাটপার। আর হামাক পাঠে দিছে ধান কাটপার। হামরা ১৩-১৪ জন ধান কাটপার আসছি। আর বাকিগুলা মেম্বারের বাড়িত মাটি কাটপার নাগছে।
লিখিত অভিযোগকারী ওই ওয়ার্ডের শ্রমিক জকরুল ইসলাম বলেন,আমি রোজার মধ্যে ১৭ দিন মাটি কাটার কাজ করেছি। পরে হক মেম্বার আমার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে কাজে আসতে নিষেধ করেন। কষ্ট করে ২ হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা না দেয়ায় হক মেম্বার আমার নাম বাদ দেন। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিলে পরিষদে সবার সামনে হক মেম্বার আমাকে দেড় হাজার টাকা ফেরত দেন। কিন্তু আর কাজ করতে দেননি। এই তালিকায় মেম্বারের স্কুলপড়ুয়া ছেলে লুৎফর রহমান,ভাই ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক,ঢাকায় এনজিওতে চাকরিরত ভাই নুরনবী মিয়া,জামাই সফিকুল ইসলাম,বোন নবিনা বেগম,চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ছামিউলসহ বেশ কয়েকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তারা কেউ মাটি কাটার কাজ করেন না।
এ বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো লাভ হয়নি। ভোগডাঙ্গা ইউপির মেম্বার আব্দুল হক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট সদর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের কিসাশত পুলকর গ্রামে ৩৭ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক মাটি কাটার কাজ করছেন। অথচ সেখানে ৪৯ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও ওই ওয়ার্ডের মেম্বারের আত্মীয়স্বজন শ্রমিক হওয়ায় তারা কাজ করেন না। গত ঈদের আগে এই উপজেলায় ৩২ দিনের কাজের বিল দেয়া হয় ১২ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ২৬ জন শ্রমিক বিল পাননি। আর বাকি শ্রমিকরা ঈদের দিন ও পরের দিন মাত্র ৮ হাজার টাকা মেম্বারের কাছ থেকে পেয়েছেন।
এ ছাড়া শ্রমিকদের কাছে থাকা সিম নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে রাজারহাটের ৩ নং ওয়ার্ডের শ্রমিক সরদার সত্তেন রায় বলেন,আমার অধীনে ৪৯ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। কিন্তু নিয়মিত কাজ করে ৩৭-৩৯ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক। বাকিরা আসে না কাজও করে না।এদিকে মেম্বার আশরাফ আলী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আমরা ১০ জন ইউপি সদস্য ১৪টি বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ এনে লিখিতভাবে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়েছি।চেয়ারম্যানের ভয়ে শ্রমিকরা নিজেদের কাছে সিম কার্ড রেখে মেম্বারদের দোষ দিচ্ছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন,মেম্বাররা যে অভিযোগ এনে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়েছেন,তার কোনো ভিত্তি নেই। বরং মেম্বাররা ইজিপিপি প্লাস প্রকল্পে তাদের আত্মীয়স্বজনের নাম দেয়া,সিম কার্ড নিজেদের কাছে রাখা এবং কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোসহ নানা নিয়ম করছেন। সঠিক শ্রমিকের বিল স্বাক্ষর করায় তাদের আয় বন্ধ হয়েছে বলেই তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এদিকে ভোট না দেয়ার অভিযোগে উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে ১৫ জন শ্রমিকের নাম ছাঁটাই করে নতুন নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জেলা কো-অর্ডিনেটর এস এম জাবেদ বলেন,কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলার ৭৩টি ইউনিয়নে ইজিপিপি প্লাস প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হয়ে আগামী ৭ জুন পর্যন্ত ইজিপিপি প্লাস প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষ হবে। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক হাজিরা হিসেবে ৪০০ টাকা এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে সরদার পাবে ৪৫০ টাকা করে। শ্রমিকদের তাদের নিজস্ব মোবাইলে রকেটের মাধ্যমে এসব বিল দেয়া হয়। শুধু উলিপুর উপজেলা বাদে বাকি উপজেলায় গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত শ্রমিকদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এই কর্মসূচি শ্রমিকের হাজিরা দেখভাল করার জন্য জেলার ৯টি উপজেলায় ১৮ জন কমিউনিটি মোবাইলাইজিং সদস্য কাজ করছে। জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন,এ প্রকল্পে আমরা বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। নীতিমালার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিল দেয়া হচ্ছে। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করে কিছু সমাধান করতে পেরেছি। আর যেগুলো পেইন্ডিং রয়েছে,সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।