আগস্টের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদে ভূয়া বিল ভাউচারের মহোৎসব
হারুন অর রশিদ:
সম্প্রতি দেশজুড়ে আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদে ভূয়া বিল ভাউচারের মহোৎসব চলছে। ছাত্র আন্দোলনের পর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ বিলুপ্ত হলেও সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে আতাঁত করে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফিরুজুল ইসলাম। নিয়ম না থাকলেও পদ স্থগিত হওয়া চেয়ারম্যানের ব্যাকডেটে স্বাক্ষর করে ভূয়া-বিল ভাউচারে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের কথা দাম্ভিকতার সাথে স্বীকার করেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনে দমনেও ৪ আগস্ট হাজারো ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ভূড়িভোঁজের আয়োজনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জেলা পরিষদ থেকে দমন হতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গুরুতর সব অভিযোগ নিয়ে অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পর গত ১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান পদ বিলুপ্তি হলে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন ও সংস্কার দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচার করে সাবেক চেয়ারম্যান ওবাইদুর রহমান সহ প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বিল ভাউচারের টাকা সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকের চেকে সিগনেটরি হিসেবে পূর্বের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজেও চেকে স্বাক্ষর করে উক্ত টাকা গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক হতে উত্তোলন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের জনৈক এক স্টাফ বলেন, লেনদেন কো¬জ হওয়ার কথা ছিল ১৭ আগস্টে। ১৮ আগস্ট হতে ডিসি অতিরিক্ত দায়িত্ব নিলেও ১১ সেপ্টেম্বরের আগে কোন চেক স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু অবৈধ সুবিধা নিতে ১৮ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের লেনদেন করা হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের মনগড়া পরিষদ চালাচ্ছেন। যা ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখলে সত্যতা মিলবে।
জেলা পরিষদে নতুন প্রশাসক হিসেবে ডিসি কে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয় গত ১৮ আগস্ট। তিনি জেলা পরিষদের প্রথম চেক স্বাক্ষর করেন ১১ সেপ্টেম্বর। কোন অফিসের সিগনেটরি পরিবর্তন হলে তিনি তার শেষ কর্মদিবসে চেক রেজিষ্টার খাতা সমাপ্তি করে চলে যাওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। কিন্তু ওই অফিসের হিসাব শাখায় চেক রেজিষ্টার সমাপ্তি করার করা ছিল ১৭ আগস্ট এবং পরদিন ১৮ আগস্ট হতে ডিসির নতুন স্বাক্ষরে রেজিষ্টার ওপেন করার করা ছিল। বাস্তবে তা হয়নি। দেরিতে চেক রেজিষ্টার বই ক্লজ করায় বিধি বহির্ভূতভাবে আগস্ট মাসের ষ্টাফদের বেতন প্রদান করা হয় ১২সেপ্টেম্বর।
অপরদিকে, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুর রহমান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গত ৪ আগস্ট ছাত্রলীগের হাজারো নেতা-কর্মীকে অস্ত্র, লাঠি সোঠা নিয়ে জেলা পরিষদের ভিতরের ডাকবাংলোতে অবস্থান করার যাবতীয় লিড দেন এবং ওই দিন সকল ছাত্রলীগ কে দুপুরের খাওয়ার জন্য ডাকবাংলোতে রান্না করেন। ছাত্রলীগের এই রকম মারমুখি অবস্থান দেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট জেলা পরিষদ অফিস ভাংচুর হয়। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান সহ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকেই দায়ী করছেন অফিসের সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, অফিসের গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রংপুরে তার নিজের ফ্ল্যাটে প্রতিদিন রাত্রী যাপন করার কারনে প্রতিদিন বিকেলে গাড়ী নিয়ে রংপুরে যান এবং গাড়ী তার বাসায় রেখে ড্রাইভারকে কুড়িগ্রামে বাসে করে রাতে পাঠিয়ে দেন। পরেরদিন সকাল বেলা ড্্রাইভার কুড়িগ্রাম থেকে বাসযোগে আবার রংপুর গিয়ে তাকে কুড়িগ্রাম নিয়ে আসেন। কর্মস্থলে থাকার জন্য সরকারি নিজস্ব কোয়াটার থাকলেও তিনি সে কোয়াটারে থাকেন না।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার কুড়িগ্রাম থেকে প্রতিদিন রংপুর যাতায়াত করেন। আমি তাকে রংপুরে রেখে কুড়িগ্রাম চলে আসি। স্যার যা বলেন তাই করতে হয়।’
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফিরুজুল ইসলাম বলেন, প্রশাসক না থাকায় পূর্বের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে বিল-ভাউচার পাড় করা হয়েছে। যা করেছি অফিসের ভালোর জন্যই করেছি। ব্যক্তিগত কোন কাজে করি নাই। আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সত্য নয়।’
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন ‘আমি নতুন যোগদান করেছি, বিষয়টি অবগত নই। যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে কোন ছাড় নয়, নিয়মের বাইরে কোন কাজ হবে না। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’