চাকরির বয়সসীমা ৩২ প্রত্যাখ্যান, ৩ বার বিসিএসের নিয়ম ‘অযৌক্তিক’
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারবেন প্রার্থীরা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বয়সসীমা ৩৫-প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’। একইসঙ্গে স্থায়ীভাবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এদিকে, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী তিনবারের বেশি অংশ নিতে পারবেন না। সর্বোচ্চ তিনবার বিসিএস দেয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ চাকরিপ্রার্থীরা। এ নিয়ে প্রয়োজনে তারা আন্দোলনে নামবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।-খবর তোলপাড়।
শিক্ষাবিদ ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বেঁধে দিলে সেই পর্যন্ত সবার আবেদন করার সুযোগ রাখা উচিত। আর আবেদন করার সুযোগ সীমিত করলে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, বয়স বেঁধে দেওয়ার পর কতবার আবেদন করতে পারবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়াটা সম্পূর্ণ ‘অযৌক্তিক’।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে ৩৫-প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরা সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৫ করার জন্য দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত যে সুপারিশ কমিটি গঠন করেছিল, সেখানে আমাদের দাবির প্রতিফলন ঘটেছিল। সেজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। তখন আমরা বলেছিলাম, সুপারিশ কমিটির সুপারিশটি যেন সরকার বহাল রাখে। কিন্তু আজ সরকার জানিয়েছে এটি ৩২ বছর করা হয়েছে। এতে আমাদের দাবি-দাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি।
তিনি বলেন, আমরা সরকারের আজকের সিদ্ধান্তকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। আশা করি, দ্রুত সরকারের বোধদয় হবে এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করবে।
নতুন কর্মসূচির বিষয়ে শরিফুল হাসান শুভ বলেন, আমরা শিগগির আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেবো। সংবাদ সম্মেলন করে পরে কর্মসূচির বিষয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে।
তিনবারের বেশি বিসিএস নয়— এ কথা মানতে নারাজ প্রার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র রাকিবুল হাসান। ২০২১ সালের নভেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়া ৪৪তম বিসিএসে প্রথমবার অংশ নেন তিনি। তাতে প্রিলিমিনারিতে বাদ পড়েন। ৪৫তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে ৪৬তম বিসিএসে আবারও প্রিলিমিনারিতে ফেল করেছেন।
তিনি বলেন, সরকার যে তিনবার পরীক্ষায় অংশ নেয়ার নিয়ম করতে যাচ্ছে, তাতে তো আমি আর বিসিএসে অংশ নিতে পারবো না। যদি ৪৫তম বিসিএসে আমি লিখিত পরীক্ষায় না টিকতে পারি, তাহলে আমার স্বপ্ন শেষ। অথচ আমার বয়স এখন ২৮ বছর ৯ মাস চলছে। তার মানে আমার আরও তিন বছরের বেশি বয়স রয়েছে। বয়স থাকবে অথচ বিসিএসে অংশ নিতে পারবো না। এ নিয়ম মানি না। এটা বৈষম্যমূলক।
সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আয়েশা সিদ্দিকা আশা বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘ সেশনজট। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সেশনের, তাদের দেড় বছর আগে মাস্টার্স শেষ। আমরা মাত্র মাস্টার্স শুরু করছি। স্নাতক শেষ করতেও তাদের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে আমাদের। আমি মনে করি, সরকার যদি এ সীমা ঠিক করে দিতে চায়, তাহলে সেটা অন্তত পাঁচবার করা উচিত। এর নিচে হলে চাকরিপ্রার্থীরা কেউ এটা মানবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান। জনপ্রশাসন, ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। তার মতে, বিসিএসে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষা দেওয়া যাবে, এটা কোনো দিক থেকেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়।
অধ্যাপক সাদিক হাসান বলেন, ‘বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু আপনি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ঠিক করে দিচ্ছেন, আবার কতবার আবেদন করা যাবে; সেটাও ঠিক করে দিচ্ছেন। এখানে তো একটার সঙ্গে আরেকটা নিয়মের স্পষ্ট বিরোধ দেখা যাচ্ছে। যদি আবেদনের সুযোগ সর্বোচ্চ তিনবার দেওয়া হয়, সেখানে তো বয়সসীমার প্রয়োজন নেই।’
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বয়সসীমা ৩২ বছর করা এবং তিনবারের বেশি বিসিএসে অংশ নেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে দ্রুত আদেশ জারি হতে পারে। তবে তিনবারের বেশি যে বিসিএসে অংশ নেওয়া যাবে না, এটা বাস্তবায়নে প্রথমে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিধিমালা, ২০১৪’ সংশোধন করতে হবে। ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ধারা ৫৯-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিধিতে সংশোধন বা সংযোজন আনবে।
কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন- যারা এরই মধ্যে তিনবার বিসিএসে অংশ নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে কি না। পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার শাখা) আনন্দ কুমার বিশ্বাস বলেন, বিষয়টি নিয়ে কোনো নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত আমাদের এখানে আসেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেভাবে বলবে, আমরা সেভাবে করবো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ বলেন, এটা তো আজকের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত। বয়সসীমার বিষয়টি তো ক্লিয়ার (স্পষ্ট)। বাকি যে বিষয়টি (বিসিএসে সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণ), সেটা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।
তিনি বলেন, তবে আমার ধারণা— নতুন একটি নিয়ম করা হলে শুরুটাও সেখান থেকে নতুন করে হয়। অর্থাৎ, সামনের বার যারা বিসিএসে প্রথমবার অংশ নেবেন, সেখান থেকে নিয়মটা শুরু হওয়ার কথা। তবুও আলোচনার আগে এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা সম্ভব নয়।