কুড়িগ্রামে হত্যা মামলায় ৩ সাংবাদিককে জড়ানোয় টিআইবি, সুজন, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগ ও ক্ষোভ
সংবাদদাতা,কুড়িগ্রাম:
কুড়িগ্রামে একটি হত্যা মামলায় ৩ সাংবাদিককে জড়ানোর ঘটনায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাব, টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এনিয়ে সাংবাদিক, ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ করেছেন প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন। স্মারকলিপি দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে। অপরদিকে কুড়িগ্রাম জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছে এই মামলার সাথে তাদের কোনোই সম্পৃক্ততা নেই। নিহতের পরিবার বলছেন, মামলার বাদিকে তারা চেনেন না। নেই আত্মীয়তার সম্পর্কও।
জানাগেছে, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময় কুড়িগ্রামে আশিকুর রহমান (আশিক) নামের এক শিক্ষার্থী আহত হন এবং গত ০১ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ১০ অক্টোবর কুড়িগ্রাম সদর থানায় ১০৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলাটি করেন।
বাদী রুহুল আমিন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের সেনের খামার গ্রামের বাসিন্দা। তবে তিনি নিহত আশিকুরের পরিবারের কোনো সদস্য বা স্বজন নন। নিহত আশিকুরের পরিবারের সদস্য কেউ তাঁকে চেনেনও না।
নিহত আশিকুর কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের সাতভিটা গ্রামের কৃষক চাঁদ মিয়ার ছেলে। উলিপুরের পাঁচপীর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
উক্ত মামলায় দৈনিক কালের কন্ঠ ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল খালেক ফারুক, এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের জেলা প্রতিনিধি ইউসুফ আলমগীর এবং দৈনিক সংবাদ ও নিউজ টোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির সূর্যকে এ হত্যা মামলায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে আসামি করা হয়েছে।
বাচবিচারহীনভাবে মামলায় আসামি করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান লিখিত বিবৃতিতে বলেন, ‘সনাকের দীর্ঘকালীন তিন সদস্য বরাবরের মতোই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে গেছেন। তা ছাড়া, আন্দোলনের মূল চেতনার প্রতি টিআইবির নীতিমালা ও অবস্থানের সঙ্গে সংহতিসহ স্থানীয় পর্যায়ে তাদের সন্তানদের অংশগ্রহণে সহায়তা করেছেন। এই তিন সনাক সদস্যকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে আসামি করার পেছনে দুরভিসন্ধি ছাড়া কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সারা দেশে বাছবিচারহীন ও যথেচ্ছ মামলার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলা একদিকে যেমন ছাত্র-জনতার ওপর হওয়া নীপিড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে দুর্বল করছে, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদের মূখ্য সঞ্চালকদের জবাবদিহির চলমান বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে দেশ বিদেশে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কুড়িগ্রামে হত্যা মামলার আসামির তালিকা থেকে অবিলম্বে তিন সাংবাদিক ও সনাক সদস্যের নাম প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে টিআইবি।’ উল্লেখ্য, এই তিন সাংবাদিকের মধ্যে ইউসুফ আলমগীর টিআইবি সনাকের সহসভাপতি এবং আব্দুল খালেক ফারুক ও হূমায়ুন কবীর সূর্য টিআইবি সনাকের অন্যতম সদস্য।
এদিকে এ ঘটনায়, সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারও এক বিবৃতিতে বলেন, হূমায়ুন কবীর সূর্য কুড়িগ্রাম সুজনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সেই সাথে অপর ২ সাংবাদিকও সুজনের সাথে নাগরিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাদের নামে এমন মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রনোদিত মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা জরুরি।
এ ঘটনায় কুড়িগ্রাম জেলা শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সাংবাদিক, ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করেছেন। সেই সাথে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবরে সভাপতি রাজু মোস্তাফিজ বলেন, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক ফারুকসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও ক্যামেরা পার্সন গত ৪ অগাস্ট আন্দোলন চলার সময়ে কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে অবরুদ্ধ ছিলেন। কাজেই হামলার ঘটনার সাথে সাংবাদিকদের সম্পৃক্ততা কল্পনাপ্রসূত।
টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি ইউনুছ আলী বলেন, গত ৪ অগাস্ট আন্দোলন চলার সময় ছাত্রলীগের ততকালীন সভাপতিসহ কয়েকজনের রোষানলে পরে পৌরবাজারস্থ টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামে হামলা হয়। সেখানে আমি নিজে আহত হই এবং কয়েকজন সাংবাদিকসহ ক্যামেরা পার্সনকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদকি ও এটিএন বাংলার জেলা প্রতিনিধি ইউসুফ আলমগীর এবং অন্যান্য সাংবাদিকরা এসে সকলকে মুক্ত করে। সেখানে ৩ সাংবাদিকদের নাম জড়িয়ে মামলা এটি হীন কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা। সেই ঘটনায় আমি বাদি হয়ে ছাত্রলীগের সভাপতিসহ সংশ্লিস্ট জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছি।
টিআইবির অনুপ্রেরণায় গঠিত কুড়িগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটি সনাকের সভাপতি এ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু বলেন, “এই তিন মিডিয়াকর্মী সনাকের কুড়িগ্রামের সক্রীয় সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ঘটনার দিন তারাসহ অধিকাংশ সাংবাদিক তৎকালীন সরকারি দলের হুমকি-ধামকি ও রোষানলে পড়েন। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করতে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে । সাংবাদিক হয়রানি বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মামলায় তিন সাংবাদিককে আসামি করায় বাদী রুহুল আমিনের সমালোচনা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা। এ সম্পর্কে কুড়িগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কে এম নাজমুস সাকিব শাহী, রাজ্য জ্যোতি বলেন, ‘আন্দোলনের শুরু থেকে আমরা যাঁরা জড়িত ও নেতৃত্বে ছিলাম তাঁরা সবাইকে চিনি এবং জানি। কিন্তু আশিক ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে মামলার বাদী রুহুল আমিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। মামলার আগে তাঁর নামও শুনিনি। মামলায় তিন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু ওই তিনজনই আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। একজন সাংবাদিকের ছেলেমেয়ে আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ রকম হয়রানি, মিথ্যা মামলা সর্বোপরি অরাজকতা আমরা বরদাশত করব না।’
মামলার বিবরণে বলা হয়, গত ৪ আগস্ট আন্দোলনের সময় মিছিলে গিয়ে হামলায় আহত হন আশিকুর রহমান, তাঁর ছোট ভাই আতিকুর রহমান ও বাদী রুহুল আমীন। তাদের কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ১৮ আগস্ট তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হলে ১ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
মৃত আশিকের ছোট ভাই আতিকুর রহমান বলেন, ‘আশিক ভাই হত্যার ঘটনায় রুহুল আমীন নামের কেউ একজন থানায় মামলা করেছেন। আমরা ওই ব্যক্তিকে চিনি না, তিনি আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নন। এমনকি মামলা করার আগেও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বলেননি। মামলায় ১০৪ জন এজাহারভুক্ত আসামি এবং অজ্ঞাতনামা ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার দিন আওয়ামী লীগের এত লোকজন ছিলেন না।’
এ বিষয়ে জানার জন্য মামলার বাদী রহুল আমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
কুড়িগ্রাম সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল আলম বলেন, আশিকুর হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে এজাহার নামীয় ১০৪ জনেক আসামি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ এজাহারভুক্ত কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। কুড়িগ্রাম আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ ঘটনায় সাংবাদিকদের স্মারকলিপি গ্রহণকালে কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজার রহমান সাংবাদিকদের আশ্বস্থ করে বলেন, ৩ সাংবাদিকসহ নিরপরাধ কাউকেই হয়রানী করা হবে না।