মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:৪৬ অপরাহ্ন

দারিদ্রতা ও অসচেতনাতায় কুড়িগ্রামের মেয়েরা সবচেয়ে বেশী বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে

রিপোর্টারের নাম / ৪৯ টাইম ভিউ
Update : বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

প্রহলাদ মন্ডল সৈকত:

কুড়িগ্রামের মেয়েরা বাংলাদেশের সব থেকে বেশী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। সামাজিক সচেতনতার অভাব, শিক্ষা ও দারিদ্রতার কারণে এজেলায় বাল্যবিবাহ বেশি হয়। স্থানীয় সরকার ও অংশিজনদের সমন্বয়হীনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় প্রতিদিন শিশুরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। পরিস্থিতি পরিবর্তনে কন্যা শিশুদের সুরক্ষায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণা ও সামাজিক কর্মসূচি বাড়ানো দরকার।

বুধবার(২০ নভেম্বর) কুড়িগ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস কার্যালয়ের অনুষ্ঠিত ‘বাল্যবিবাহ মুক্ত কুড়িগ্রাম, সংকট ও সমাধান এবং চাইল্ড, নট ব্রাইড প্রকল্পের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় আরডিআরএস বাংলাদেশ এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। গোলটেবিল বৈঠকটির সঞ্চালনা করেন আরডিআরএস বাংলাদেশ এর হেড অব সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট মুজিবুল হক মুনীর এবং স্বাগত বক্তব্য দেন আরডিআরএস বাংলাদেশ এর কো-অর্ডিনেটর(পাবলিকেশন এন্ড কমিউনিকেশন) আশাফা সেলিম।

গোলটেবিল বৈঠকে জেলার রৌমারী, রাজীবপুর, চিলমারী, উলিপুর, রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নির্বাচিত সাংবাদিক প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার ইউপি চেয়ারম্যান, ইমাম, ঘটক,কাজি, শিক্ষক, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, যুব, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আরডিআরএস প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে বাল্যাবিবাহ নিরসনে জেলার সংকট ও সমাধান শীর্ষক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

কুড়িগ্রাম নানাবিধ দিক থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া একটি জেলা। এ জেলার মানুষ বিশেষ করে কন্যা শিশুরা দারিদ্রতা ও সামাজিক সচেতনতার কারণে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়ে। কন্যা শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে চাইল্ড, নট ব্রাইড বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করেছে উল্লেখ করে প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রকল্পের বিশ্লেষণ ফলাফল তুলে ধরেন।

সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, জেলার ৪৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্প কাজ করে। বর্তমানে এই জেলায় ৩ হাজার ৫৭৬ জন কন্যা শুশু বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু আমরা বাল্যবিবাহের ঝুকি নিরসনে ৯ হাজার কিশোর-কিশোরীকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকার সম্পর্কে সেশনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতন করেছি। একই সাথে ৮১০ জন চ্যাম্পিয়ন বাবা মায়ের মাধ্যমে ৮ হাজার ১০ জন অভিভাবককে সচেতন করেছি।

এদের মধ্যে বাল্যবিবাহের অধিক ঝুঁকিতে থাকা ১ হাজার ২০০ পরিবারকে ১৭ হাজার করে আর্থিক সহায়তা প্রদান ও ওই পরিবারের ২৪৩ জন সদস্যকে আয়বর্ধকমূলক প্রশিক্ষণ, যুব সদস্যদের ৩৯৩ জনকে বিভিন্ন ট্রেডে দর্জি, বিউটিশিয়ান, মোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আলচনায় অংশ নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের টেকনিক্যাল স্পেশালিষ্ট (ইউথ লিডারশিপ) শারমীন মমতাজ বলেন, কুড়িগ্রামকে বাল্যবিবাহ মুক্ত করতে হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও যুবকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে পারলে বাল্যবিবাহ মোকাবেলায় সংকট অনেকাংশ কমে আসবে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সাথে বেসরকারি সংস্থা ও বিভিন্ন অংশীজনদের একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ চিরতরে বন্ধ হবে। বাল্যবিবাহ মুক্ত কুড়িগ্রাম গঠন করতে হলে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যুবাদের পাশাপাশি কাজিদের ভূমিকা জরুরী উল্লেখ্য করে কুড়িগ্রাম জেলা কাজি সমিতির সভাপতি মাওলানা নুরুজ্জামান বলেন, আরডিআরএস এর সিএনবি প্রকল্পের যুব সদস্য ও অভিভাবকদের সচেতনতার কারণে কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিবাহ কিছুটা কমেছে। পুর্বে কাজীদের দুইটি বই থাকতো, একটিতে তারা বাল্যবিবাহ হওয়া শিশুদের বিবাহ রেজিস্ট্রি করতেন এবং অন্যটিতে পরিপক্ক নারীদের বিবাহ রেজিস্ট্রি করতেন। বর্তমানে সেটি আর নেই।

বাল্যবিবাহ হলেই সব দায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ঘাড়ে চলে আসে বলে মন্তব্য করেন হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করীম রেজা। তিনি বলেন, যখন যেখানে বাল্যবিবাহ হয় সেখানেই শুনবেন জন্মক নিবন্ধন নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। অতীতে জন্ম নিবন্ধন জাল করেও বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রি হয়েছে সেরকম রেকর্ড আছে। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন আসায় সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে বাল্যবিবাহ কিন্তু বন্ধ হয়নি। এখনো কিছু কিছু অসচেতন অভিভাবক বিবাহ রেজিষ্টি বাদ রেখেই গোপনে মেয়ের বিয়ে দেন। পরে বঈবাহিক জীবনে সমস্যা দেখা দিলে আসেন জন্ম নিবন্ধন নিতে। এসময় শুধু তাঁর বাল্যবিবাহের কথাটি প্রকাশে আসে। জেলায় এখনো ৭০ ভাগ শিশু তাদের নিজেদের পরিবারের কারণেই বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে উল্লেখ্য করে জেলা তথ্য কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, ভৌগলিকভাবে কুড়িগ্রাম জেলা দারিদ্রতার মধ্যে থাকলেও অতীতের তুলনায় অভাব কিছুটা কমেছে।

জেলার চর এলাকা গুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে সেখানকার পরিবারগুলো তাদের মেয়ে শিশুটির বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। রাতারাতি এই পরিবর্তন সম্ভব নয়, তবে ধীরে ধীরে এগুলো পরিবর্তন হচ্ছে। চাইল্ড নট ব্রাইড এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চার ঘণ্টাব্যাপী গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন হলোখানা ইউনিয়ন যুব নেতা জান্নাতুল ফেরদৌস, রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের যুব নেতা সানজিদা পারভীন শিউলি, ঘটক শাহেরবানু, জেলা মহিলা বিষয় কর্মকর্তা জেবুন্নেছা ইয়াসমিন, কুড়িগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মনজুর রহমান, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রতিনিধি ডা. আজিজ প্রধান প্রমুখ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর