শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন

ব্রজেন দাস: এক গৌরবময় ইতিহাসের নাম 

রিপোর্টারের নাম / ৯২ টাইম ভিউ
Update : বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০২৪

।। শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক ।।

কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, আমি হচ্ছি ‘কিং অফ রিং’ আর আপনি হচ্ছেন ‘কিং অফ চ্যানেল’, আপনার অর্জন আমার চেয়ে ঢের বেশি গৌরবের। ১৯৮৫ সালে সাফ গেমসে ব্রজেন দাস-কে উদ্দেশ্য করে আলী এ মন্তব্য করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন: ব্রজেন তুমি মিরাকল দেখিয়েছো,বাঙ্গালীরা তোমার জন্যে গর্বিত। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু বলেছেন: জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই আপনার জন্যে গর্বিত। আইয়ুব খান বলেছেন: মাই বয়, প্রতিটি পাকিস্তানীর হৃদয়ে তোমার নাম লিখা থাকবে। ব্রজেন দাস ছিলেন এশিয়ার প্রথম সাঁতারু যিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রানী এলিজাবেথ-র সাথে দেখা করেন। রানী তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, চমৎকার অর্জন, আপনার কৃতিত্বের জন্যে সহৃদয় ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

বাংলাদেশে আজকের নুতন প্রজন্ম কি ব্রজেন দাস-কে জানে? আমার সৌভাগ্য তিনি আমায় চিনতেন। সেই গল্প বলবো, এর আগে বলে রাখি গুগুলে তার নাম লিখলে বহু তথ্য জানা যাবে, তাঁর পরিবার ‘ব্রজেনদাসডটকম’ নামে একটি ওয়েব সাইট খুলে রেখেছে। ইন্টারনেটে যা আছে তা থেকে কিছু হয়তো বলবো, এর বাইরেও কিছু যোগ করবো, যা একান্তই আমার বক্তব্য। অনেকদিন আগের কথা। সময়টা হয়তো ৮০’র দশকের প্রথম থেকে মধ্যভাগ। আমার আস্তানা তখন জাতীয় প্রেসক্লাব। একদিন দুপুরে খাচ্ছি, এক ভদ্রলোক এসে টেবিলে বসলেন। চিনলাম না? প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সদস্য ছাড়াও নামীদামী ব্যক্তিগণ ‘সহযোগী’ সদস্য থাকতেন। ভদ্রলোক নাদুস-নুদুস, কিছু অর্ডার দিলেন। এমনিতে সদস্যরা প্রায় সবাই একে অপরকে চিনতো, সহযোগী সদস্যরা আসতেন অনিয়মিত, তাদের সবাইকে চেনার উপায় ছিলোনা।

একই টেবিলে দু’জন খাচ্ছি, কথা নেই? ঐসময় অন্য কেউ একজন এসে টেবিলে বসলেন, খুব সম্ভবত: তিনি অবজারভারের অতিকভাই। অতিকভাই আমায় যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন আমরা কথা বলছি না, জিজ্ঞাসা করলেন, শিতাংশু, তুমি ওনাকে চেনো না? বললাম, না। একটু অবাক হলেন, কোন ভনিতা না করেই বললেন, ‘উনি ব্রজেন দাস।’ আমার তো তখন আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। বললাম, নমস্কার দাদা, আপনি ব্রজেন দাস, আপনার গৌরব কথা তো আমার পাঠ্য ছিলো। স্বভাবত: আমি গদগদ হয়ে গেলাম। তিনি মৃদু হাসলেন। অতিকভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন, শিতাংশু-বাংলারবানী। সেদিন ব্রজেন দাস-র সাথে অনেকক্ষন সময় কেটেছিলো। খুশি হয়েছিলাম, এই সেই বিখ্যাত ব্রজেন দাস? অথচ তিনি কত সাধারণ। আরো পরে শুনেছিলাম তাঁর দু:খের কথা, জেনেছিলাম অবহেলা-বঞ্চনার ইতিহাস।

পাকিস্তান আমলে তিনি সম্মানিত হ’ননি, বাংলাদেশও তাকে যোগ্য সন্মান দেয়নি। এনিয়ে তার মনে দু:খ ছিলো, অভিমান ছিলো। তিনি বিখ্যাত ব্রজেন দাস, আমি অখ্যাত-বয়সে অনেক ছোট, ডাকতাম, ‘ব্রজেনদা’। ১৯৯০’র মধ্যভাগে আমি আমেরিকা চলে আসি। এরপর একদিন ব্রজেন দাস’র গল্প শুনি আর এক বিখ্যাত সাঁতারু মোশাররফ হোসেন-র কাছে। তখন তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ব্রজেনদা’র মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাবলীও জানি মোশাররফ হোসেনের কাছ থেকে। ব্রজেন দাস’র জন্ম ৯ই ডিসেম্বর ১৯২৭ মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের কুচিয়ামোড়া গ্রামে। মৃত্যু ১লা জুন ১৯৯৮। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশে মোশাররফ হোসেন সতীর্থ সাঁতারু ব্রজেন দাসের মরদেহ কলকাতা থেকে ঢাকা আনতে যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লাশ দেশে এলো, যথাযোগ্য মর্যাদায় পোস্তগোলা শ্মশানে তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

জীবিত অবস্থায় না হলেও মরণের পর তিনি সন্মান পেয়েছেন বটে। পরের বছর (১৯৯৯) তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরুস্কার দেয়া হয়। ব্রজেন দাস সাঁতার শেখেন বুড়িগঙ্গা নদীতে। ১৯৫৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম প্রতিযোগিতায় তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্রজেন দাস ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ইতালির কাপ্রি দ্বীপ হতে নাপোলি পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দূর পাল্লার সাঁতারে ৩য় স্থান অধিকার করেন। একই বছর আগষ্টে তিনি ইংল্যান্ডে বিলি বাটলিনের চ্যানেল ক্রসিং প্রতিযোগিতায় ২৩টি দেশের ৩৯ জন সাঁতারুকে হারিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। সেপ্টেম্বরে তিনি ইংলিশ চ্যানেল ইংল্যান্ড হতে ফ্রান্সে সাঁতার কেটে পার হন। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালের আগস্টে তিনি ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড সাঁতার কাটেন। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল সবচেয়ে কম সময়ে, মাত্র ১০ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে পার হয়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন।

১৯৫২ সালে ব্রজেন দাস পশ্চিমবঙ্গে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হন। পূর্ব-পাকিস্তান জাতীয় সাঁতারে ১০০, ২০০, ৪০০, ও ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি ১৯৫৩-১৯৫৬, পরপর ৪বার শিরোপা অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে শিরোপা জেতেন। ১৯৫৬ অলিম্পিকে তিনি পাকিস্তান সাঁতার দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স’ পুরুস্কারে ভূষিত করে। শেষ জীবনে তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হ’ন, চিকিৎসার জন্যে ১৯৯৭ সালের জুন তিনি কলকাতা যান, ১লা জুন ১৯৯৮ সালে সেখানেই তার মৃত্যু হয়, ৩রা জুন ঢাকার পোস্তগোলা শ্মশানে তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে তাকে ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার’ প্রদান করেছিলো।

আমার সৌভাগ্য, আমি ব্রজেন দাসকে চিনতাম। সামাজিক মাধ্যমে কেউ তার জন্মদিনে কিছু লিখেছিলেন, যা আমায় উৎসাহ যোগায়, তাকে নিয়ে লিখতে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ব্রজেন দাস ঢাকার কেএল জুবলী স্কুল থেকে ১৯৪৬সালে মেট্রিক এবং কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ পাশ করেন। অমিতাভ বচ্চন নয়াদিল্লিতে ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে বলেছেন, দাদা, জয়া আমাকে আপনার অর্জন সম্পর্কে জানিয়েছে, আমি আপনার অটোগ্রাফ চাই, এটি রেখে দেবো এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখাবো। পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণর লেঃ জেঃ আজম খান বলেছিলেন, ‘তু বাঙ্গাল কা শের হ্যায়’। ভাসানী দোয়া করেছিলেন। এরশাদ বলেছিলেন, আপনি দেশের সম্পদ। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় বলেছিলেন, তুমি বাঙ্গালীর নাম রেখেছো, বিশ্ব তোমায় মনে রাখবে। ব্রজেন দাসের ম্যানেজার এস এ কামাল ১৯৫৮ সালেই লিখেছিলেন, ‘তু নে কামাল কিয়া ভাই’।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর