উলিপুরে বাকরেরহাট ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি।। তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের গড়িমসি
তৈয়বুর রহমান:
কুড়িগ্রামের উলিপুরে বাকরেরহাট ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসার দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছে । কিন্তু মাদ্রাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রশি টানাটানির কারণে দীর্ঘদিনেও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অভিযোগকারী ছাত্রজনতা সহ অভিভাবক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাধতে শুরু করেছে।
এদিকে, অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাকসহ তার ২ সহযোগী শিক্ষক স্থানীয় জনরোসের ভয়ে দুই মাস ১৮ দিন থেকে মাদ্রাসায় অনুপস্থিত রয়েছে। ফলে মাদ্রাসাটিতে পাঠদানসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে । এ অবস্থায় অভিভাবক মহলে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা তীব্র আকার ধারণ করছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলীসহ স্থানীয় কতিপয় নেতার প্রত্যক্ষ মদদে অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক মাদ্রাসায় নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তার পারিবারিক লোকদের নিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিতে অধ্যক্ষের নিজের মেয়ে জামাইকে সভাপতি, মেয়ে ও ভাগ্নে শিক্ষক প্রতিনিধি, আপন ভাই ও ভায়রা বিদ্যুোৎসাহী সদস্য,নিজের স্ত্রী সহ আত্মীয়-স্বজনকে দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। পারিবারিক কমিটি অনুমোদন পাওয়ায় মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারীরা ভয়ে কেউ ঐ অধ্যক্ষের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না।
অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন উলামালীগের নেতা হিসেবে নিজেকে জাহির করে মাদ্রাসাটিকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে রূপান্তর করেন। শিক্ষকদের টিউশন ফি ও টাইম স্কেল প্রদানে দুর্নীতি , মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদান না করা , প্রতিষ্ঠানের জমি লিজ প্রদানে দুর্নীতি , মন্ত্রণালয়ের অডিটর ম্যানেজ করার নাম করে শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন। তার যোগদানের সময় থেকে এ পর্যন্ত নয় জন শিক্ষককে নিয়োগ দিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকরা সকলেই তার আত্মীয়-স্বজন।
এরকম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হলে প্রতিবাদী জনতা নড়ে চড়ে বসে। হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট স্থানীয় স্থানীয় সহস্রাধিক ছাত্র জনতা ও অভিভাবক দুর্নীতিবাজ ওই অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবিতে সকাল দশটায় তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের হাত থেকে তাকে উদ্ধারে স্থানীয় উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ হলে রাত ১০টায় কুড়িগ্রাম থেকে সেনা ক্যাম্পের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে ১৪ ঘন্টা পর তাকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। এরপর উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আতাউর রহমান বিষয়টি তদন্তের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল হাইকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত সম্পন্ন করে দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু রিপোর্ট লেখার সময় ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করেনি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানান,সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিধিমালা অনুযায়ী অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা। কিন্তু পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সরকার সব মাদ্রাসার কমিটি ভেঙে দিলে এই মাদ্রাসাটির সভাপতির দায়িত্ব নেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) উত্তম কুমার। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিধিমালা অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রহস্যজনক কারনে বিষয়টি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করে দীর্ঘ কালক্ষেপণ শুরু করেন।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিধিমালা মোতাবেক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সমস্ত ক্ষমতা কমিটির সভাপতিকে দেয়া হয়েছে। এটি তিনি করবেন। এ অবস্থায় কমিটির সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে রশি টানাটানির কারণে দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় স্থানীয় ছাত্র জনতা ও অভিভাবক মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কুড়িগ্রাম উত্তম কুমার তদন্ত প্রতিবেদন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা স্বীকার করে বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।